এক.
আজকে আমার মনটা অনেক ভাল। অফিসে বেশ জটিল একটা সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। বস ডেকে নিয়ে ধন্যবাদ দিল, যদিও জানি বছর শেষে মূল্যায়নের সময় এগুলো তার কিছুই মনে থাকবে না। সেই সময় তার কামরায় স্পেশাল কিছু লোকের আনা গোনা বেড়ে যাবে, কাজের সময় সাধারণত যাদের কে পাওয়া যায় না। ঐ সময়টাতে আমি আবার কাছাকাছি থাকতে পারিনা। ফলে মূল্যায়নের সময় আমাকে পাওয়া যায় তলানিতে। আমি কয়েক বছর নিজে নিজে হতাশ হয়ে বুঝতে পেরেছি, হতাশা গ্রস্ত হয়ে আসলে আমি নিজেকেই শাস্তি দিয়েছি। তাই আমি এখন আর এই বিষয় নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই না।
ছুটির পর অফিস থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলাম সফির অফিসের নিচে। আমাদের অফিস মতিঝিলে, আমারটা আদমজী কোর্টে। রাস্তায় মানুষ, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, ফকির সবাইকে পাশ কাটিয়ে সফির অফিসের নিচে আসতে তেমন বেশী সময় লাগে না। ওখানে চায়ের দোকানটাতে দাড়িয়ে চায়ের কাপে এবং সিগারেটে চুমু না দিলে মনে হয় যেন যৌবন শেষ হয়ে বার্ধক্যে পৌঁছে গেছি। তাই যৌবনের শক্তি দেখানোর জন্য হলেও ওখানে যেতেই হবে। তারপর দুই বন্ধু একসাথে বাসে চেপে মিরপুর। প্রতিদিন দুই তিন ঘণ্টা বাসের মধ্যেই আড্ডা চলে আমাদের। আজকে মনে হয় সব কিছুই ভালই চলছে। সফিও তার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসতে পারল। বাস স্টপে এসে মওকা মতই বাসে দুইটা চমৎকার সিটও পেয়ে গেলাম। কিন্তু নিমিষেই বাসটা প্যাসেঞ্জারে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। অফিসের থেকে বের হয়ে আসা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত সব লোক গুলো। এদের মাঝে কারো কারো হয়তো বসের বকা খেয়ে মেজাজ তেছড়ে আছে। কারও মন আমার মতই ফুরফুরে। আমি ওদের চোখের দিকে তাকাই না। এই মানুষ গুলো অদ্ভুত এক সুখের মধ্যেই আছে। এটা সুখও না আবার অসুখও না।
সফি কথা বলতে ভালবাসে। ও একটা ব্যাংকে আছে। তার আলাপের বিষয় বেতন, বোনাস, ডেসিগনেশন, গাড়ী বাড়ী সুবিধা ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর অফিসে কে কয়টা বোনাস পেল। কি বিচারে বোনাস পেল। কি ডেসিগনেশন হলে ও একটা গাড়ী পাবে। প্রায় প্রতিদিন একই বিষয়ে আলাপ। আমি প্রতিদিন ওর প্রায় একই কথা শুনি। ও একই ভাবে বলে যেন আজকেই আমাকে পেয়েছে, আগে বলা হয়নি তাই বলছে। বাসে সময়টা আমাদের ভালই কেটে যায়।
জ্যামে গরমে অস্থির করে বাসটা শ্যাওড়াপাড়া পৌঁছল। যাত্রীদের অনেকেই নেমে গেছে। বাসে কয়েকটা সিট খালি। মাঝ বয়েসি একটা লোক উঠে সামনে দাড়িয়ে আছে, সিট খালি থাকলেও সে বসল না। আমার মনে হল লোকটাকে আগেও দেখেছি কোথাও। লোকটার পোশাক আশাক সম্ভ্রান্তই, মুখ ভর্তি সাদা কাল চাপ দাড়ি, আসাদুজ্জামান নুর টাইপ। শিক্ষিত মার্জিত চেহারা। আমার চোখ আটকে গেল লোকটার উপর। সে বাসের যাত্রীদের দিকে ইতস্তত তাকাচ্ছে, যেন কিছু একটা বলবে কিন্তু লজ্জা পাচ্ছে। বাসটা ছেড়ে দিল। কন্ডাকটর তাকে সিটে বসার জন্য তাড়া দিচ্ছে, সে তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না। লোকটা ডুকররে কেঁদে উঠল, কাঁদতে কাঁদতে কোনরকমে বলল, ভাই আপনারা আমার চার বছরের ফুটফুটে মেয়েটাকে বাঁচান। ওর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। আমাকে কিছু সাহায্য করেন। লোকটার গলা ধরে আসল, আর বলতে পারল না। লোকটা ঝুঁকে দাড়িয়ে কাঁদতে থাকল। ভণ্ড লোকের অভাব নেই, তাই এসব ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ লোক সারা দেয় না। কিন্তু লোকটার অসহায়ত্ব বাসের পরিবেশটাই পাল্টে দিল। একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ, একজন বাবা তার সন্তানের জীবন বাঁচানোর জন্য কাঁদছে, সবার মন দ্রবীভূত হওয়ারই কথা। সবাই যে যা পারল সাহায্য করছে। কিন্তু আমার মন খচখচ করে চলছে কোথায় যেন দেখেছি আমি লোকটাকে। হঠাৎ আমার মনে পরল। এই লোকটকেই তো দেখেছি বছর খানেক আগে এরকম ভাবেই মেয়ের জীবন বাঁচানোর জন্য সাহায্য তুলতে। বিশ্বাস করার জো নেই, লোকটা ভণ্ড। নিখুঁত অভিনয়। সফি মানিব্যাগ বের করতে গেল, আমি ওকে থামালাম। বললাম, তুই বিশ্বাস করবিনা লোকটা একটা ভণ্ড।
: সত্যি! তুই জানলি কিভাবে?
: আমি একে অনেক আগেও দেখেছি, এভাবেই টাকা তুলতে।
: তুই শিওর।
: হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
: মাই গড এ তো দেখছি ভয়ংকর লোক। নিখুঁত অভিনয়।
আমরা পল্লবী আসার পর বাস থেকে নামলাম। সেই লোকটাও পল্লবীতেই নামলো। বাস থেকে নেমেও আমাদের আরেক পর্ব চা সিগারেট চলে। চায়ের দোকানের দিকে না গিয়ে সফি আমাকে লোকটা যে দিকে গেছে সে দিকে যাওয়ার জন্য হাত ধরে টান দিল।
: কই যাস?
: চল আমার সাথে।
আমি বুঝতে পারলাম ও ঐ লোকটার পিছু নিতে চাইছে, বললাম, ধুর! বাদ দে তো।
: আরে চল না।
দেখলাম লোকটা ঘোর লাগা মানুষের মত টলে টলে হাঁটছে। একটু জোরে হাঁটলেই ওনাকে ধরা যাবে। সফি তাই করলো। লোকটার কাছাকাছি গিয়ে, পেছন থেকে ডাকলো, শোনেন।
ঘুরে দাঁড়াল চাপ দাড়ি ওয়ালা, জি! আমাকে বলছেন।
: আমরা বাসে ছিলাম। কি হয়েছে আপনার মেয়ের?
লোকটার চোখ আবার ভিজে উঠল বলল, ওর একটা অপারেশন করতে হবে অনেক টাকা দরকার।
: শোনেন, আমার এক আত্মীয় আছে। অনেক বড়লোক। আপনি চলেন আমার সাথে তাকে বুঝিয়ে বলতে পারলে হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারে। যাবেন?
: সত্যি আমাকে সাহায্য করবেন?
: চলেন দেখা যাক!
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ও আসলে কি করতে চাইছে আমি বুঝতে পারছি না। নিশ্চয় কোন ঝামেলা পাকাচ্ছে ও। সফি মাঝে মাঝেই আমাকে উটকো ঝামেলায় ফেলে। একবার তার এক হিন্দু কলীগের বিয়েতে আমাকে কিছু না বলে নিয়ে গেল। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে আমার সেকি অস্বস্তিকর অবস্থা। তার মধ্যে আমাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে সে কোথায় যেন চলে গেল অন্য কলিগদের সাথে। ছেলে পক্ষের এক লোক আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি মেয়ে পক্ষের লোক। ওহ! সে কি বিব্রত অবস্থা। আমি পাত্রের নামটা পর্যন্ত জানি না।
আমি বললাম, তোরা যা, আমি বাসায় যাই। সফি আমার হাত চেপে ধরে বলল, আরে চল। আমাকে মোটামুটি টেনে নিয়ে চলল। সফি লোকটাকে নিয়ে পল্লবী থানার দিকে যাচ্ছে দেখে বুঝলাম গাধাটা সত্যি সত্যি ঝামেলা পাকাতেই যাচ্ছে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি লোকটাকে দেখে। তার মধ্যে যেন কোন বিকার নেই। আমাদের সাথে লোকটা বিনা প্রতিবাদে থানায় ঢুকল। থানার সাথে আবার কোন যোগসাজশ নেইতো? থানায় আজকাল ভদ্রলোকের আনাগোনা নেই, ফলে থানার পরিবেশটাই যেন কেমন। আমার অস্বস্তিকর লাগছে।
আমরা ডিউটি অফিসারের সামনের চেয়ার গুলোতে বসলাম। আমি বিস্ময়কর ভাবে লোকটার ভাবান্তর হীন চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি। বুঝতে পারছিনা আমি কি ভুল করলাম। সত্যিই কি এই সেই লোক যাকে আমি আগে দেখেছি? সফি ডিউটি অফিসারকে সব খুলে বলল। আমার মনে হয়েছিল ভণ্ডটাকে দু' চার ঘা লাগিয়ে দেবে পুলিশ কনস্টেবল। কিন্তু তা না করে বরং সে আমাদের দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
: বলছেন আপনারা তাকে বলতেই আপনাদের সাথে থানায় চলে আসল?
তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার নাম কি?
এবার লোকটা ঘাবড়ে গেল। মনে হয় সে থানায় আসার বিষয়টা অনুমান করতে পারছে। থতমত খেয়ে বলল, জি, আব্দুল বাতেন। দেখেন আমার মেয়েটা হাসপাতালে আমাকে যেতে হবে। বলে উঠে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যত হল। ডিউটি অফিসার বলল, আপনি বসেন। আমরা আপনার মেয়ের বিষয়টা দেখছি। আপনার মেয়ে কোথায় ভর্তি?
বাতেন সাহেব বসে পড়ল বলল, শিশু হাসপাতালে।
: আপনার মেয়ের বয়স কত?
: চার বছর।
: আপনার বয়স কত! ডিউটি অফিসার আনোয়ার একটু অবাক হলেন। এ বয়সে চার বছরের বাচ্চা থাকাটা একটু অস্বাভাবিক বৈকি।
: ৩৬।
আমি অবাক হলাম, লোকটার বয়েস কমকরে হলেও ৪৫ হবে। আনোয়ার সাহেবও সন্দেহ করছেন। জানতে চাইলেন, ঠিক বলছেন? কত সালে জন্ম।
: ১৯৬৬।
তারমানে লোকটার বয়স ৪৭ প্লাস। কিন্তু লোকটা ৩৬ বলছে কেন? আনোয়ার সাহেব বললেন, আপনি থাকেন কোথায়?
: পল্লবী।
: আপনার বাসায় ফোন নম্বর আছে?
: আমরা কি যেতে পারি? আনোয়ার সাহেবের কাছে আমি জানতে চাইলাম।
: না আপনারা বসুন।
কি বিপদ, মনে মনে রাগ হচ্ছে সফির উপর। গাধাটার জন্য এখন কি ঝামেলায় পরতে হয় কে জানে। সফি মনে হয় পুরা বেপারটা এঞ্জয় করছে। আমি ওর দিকে কটমট করে তাকালাম, আমাকে পাত্তাই দিলনা। ডিউটি অফিসার আনোয়ার লোকটার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করছে। ওপাশ থেকে ফোনটা ধরতেই আনোয়ার সাহেব বললেন, আমি পল্লবী থানা থেকে আনোয়ার বলছি, এটা কি বাতেন সাহেবের বাসা?
: বাতেনের কি হয়েছে ও কোথায়? অপর পাশ থেকে ভয়ার্ত এক নারী কণ্ঠ পাওয়া গেল।
: না না আপনি চিন্তা করবেন না, উনি সুস্থ আছেন। আমার সামনেই বসে আছেন। উনার কোন মেয়ে কি শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে?
: ওহ! সব কথা থানায় এসে বলি। আমি এক্ষুনি চলে আসছি।
: জি আসুন।
আমরা একটা বেঞ্চিতে এসে বসলাম। আনোয়ার সাহেব অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি সফিকে এই সুযোগে একটু ঝাড়তে ইচ্ছে হল, এটা কি হল সফি? কি দরকার ছিল এই ঝামেলার মধ্যে জড়ানোর?
: ঝামেলার কি আছে? বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে আমার কাছে।
: ইন্টারেস্টিং এর কি হল?
: অপেক্ষা কর দেখিনা কি হয়।
দুই.
একজন চল্লিশ ঊর্ধ্ব ভদ্রমহিলা থানায় আসল তার সাথে একজন ভদ্রলোক। পরিপাটি শাড়ীতে একেবারে বাঙ্গালি রমণী। বাংলার প্রভাষক হিসাবে তাকে খুব মানিয়ে যাবে। হয়তো তিনি তাই। বয়স যার সৌন্দর্যকে এখনোও মলিন করে দিতে পারেনি। বাতেন সাহেব তাকে দেখে ছুটে আসল বলল, নিতু কেমন আছে?
: ও ভাল আছে।
: জান টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই দেখ আমার কাছে কত টাকা। বলে পকেট থেকে টাকা বের করে দেখাল।
: ওসব নিয়ে তুমি ভেবনা, কোন চিন্তা করো না।
: জান এরা ভাবছে আমি হয়তো ভণ্ড।
: ঠিক আছে আমি দেখছি বিষয়টা। তুমি এখানে বস।
বাতেন সাহেব বেঞ্চিটাতে বসল, যেন একটা শান্ত বাচ্চা ছেলে।
আমরা সবাই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুমে। ভদ্রমহিলা এবং তার সাথে আসা ভদ্রলোকটি বসেছে টেবিলের সামনে। আমরা পিছনে দাড়িয়ে। ভদ্রমহিলা বললেন, আমি নীরা, ঢাকা সিটি কলেজের বাংলার প্রভাষক, বাতেন সাহেবর স্ত্রী । উনি আদিলুর রহমান, মানসিক চিকিৎসক।
কথা বলতে বলতেই নীরা তার ব্যাগ থেকে কতগুলো ছবি বের করলেন। ছবি গুলো টেবিলে রেখে বললেন, আমাদের মেয়ে নিতু। নিতুর অনেক গুলো ছবি টেবিলে রাখলেন। আমাদের হাতেও দু’ একটা ছবি ধরিয়ে দিলেন। আমরা ছবি গুলো দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম, কি সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে। যেন দেব শিশু স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে।
বিয়ের পর আমরা বাচ্চা নিতে একটু দেরি করে ফেলি। আবার বলতে শুরু করলেন নীরা মেডাম, তাছাড়া অর্থনৈতিক ভাবেও আমরা স্টেবল হতে পারছিলাম না। বাতেন ব্যবসায় বার বার অসফল হতে থাকে। ও খুবই পরিশ্রমী কিন্তু ভাগ্য যেন কোন ভাবেই আমাদেরকে সহায়তা করছিল না। নিতু যখন আমার কোলে আসে, আমাদের খুব আর্থিক সংকট চলছে। আমিও তখন চাকুরি করিনা। কিন্তু ফুটফুটে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা আমাদের সব কষ্ট ভুলে যেতাম। বাতেন কঠিন থেকে কঠিন পরিশ্রম করত। মেয়েটা হল বাপ ন্যাওটা। বাবাও তাই। বাতেন প্রতিদিন ওকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াত। মেয়েটাও বাপের কোল ছাড়া ঘুমাতে চাইতো না। আমি এমন বাবা সচরাচর দেখি না। দিনে দিনে মেয়েটা যেন আর ফুটফুটে আর মায়াময় হয়ে উঠল, লক্ষ্মী শান্ত।
একটু থেমে আবার শুরু করলেন নীরা মেডাম, সংসারের খরচ মিট করার জন্য আমিও চাকরী খুঁজতে শুরু করলাম। এলাকার একটা বেসরকারী কলেজে নুন্যতম বেতনে প্রভাষক হিসাবে একটা চাকুরী পেয়ে গেলাম। সংসারে কিছুটা সহায়তা করা গেল। বাতেন তখন একটা ক্যাপ তৈরির ছোট একটা কারখানা করেছে। তিলতিল করে কারখানাটার জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করছে। বেশ কয়েকটা সব-কন্ট্রাক্টও পাচ্ছিল। কিন্তু এত কম প্রফিটে তাকে কাজ ধরতে হতো যে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলনা। কাজের মধ্যে কারখানাটাকে সাজিয়ে নিতে পারছিল শুধু।
নীরা মেডাম এত চমৎকার ভাবে নিজের জীবনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, আমরা সবাই বিমোহিত হয়ে শুনছি।
একবার নিতুর প্রচণ্ড জ্বর হল। তিন চারদিন পর সেরেও গেল। কিন্তু প্রায়ই মেয়েটা মাথা ব্যথায় অস্থির হয়ে যেত, কাঁদতো আর তার বাবাকে খুঁজতো। ঘুমাতে পারতোনা। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ছটফট করতে থাকতো। বাতেন সহ্য করতে পারতো না। সেও অস্থির হয়ে যেত। ছুটে ছুটে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। এলাকার ডাক্তার দেখিয়ে কিছু হচ্ছে না দেখে ডাক্তার বদলাতে থাকল। কিন্তু ভাল ফল পাচ্ছিল না। টেস্ট করতে করতে পানির মত টাকা শেষ হচ্ছিল। টাকার ব্যবস্থা করাও কঠিন হয়ে পরছিল। ফলে সে তার কারখানার যন্ত্রপাতি বিক্রি করা শুরু করল। অবশেষে একজন ডাক্তার তার রোগটা ধরতে পারল, মেডুল্লবলাস্টোমা। একধরনের ব্রেন টিউমার। অল্প সময়ের মধ্যেই অপারেশন করতে হবে। ডাক্তার ভাল ফলাফলের জন্য ইন্ডিয়া যাওয়ার পরামর্শ দিল। অনেক টাকা দরকার। বাতেন তার কারখানা বিক্রয় করে দিল কিন্তু তাতে কিছুই হবে না। আমরা আত্মীয় স্বজনদের কাছে হাত পাতছি। বিস্ময়কর ভাবে দেখলাম আমাদের কাছের লোকজন কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল। কেউ কেউ, কিছু সাহায্য করল। বাতেন পাগলের মত হয়ে গেল। টাকার সন্ধানে এখানে ওখানে ছুটে বেড়াল। সময় পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু টাকা জোগাড় হচ্ছে না। আমি ছুটছি পাসপোর্ট, হাসপাতালের খোঁজ আর ভিসার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু মেয়েটা আমাদেরকে সময় দিল না। আজ থেকে নয় বছর আগে এই দিনে মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। এত বড় আঘাত বাতেন নিতে পারল না।
এমনিতে ও কিন্তু খুবই স্বাভাবিক। বাতেনের ব্যবসা এখন অনেক বড় হয়েছে। দুই তিনটা গার্মেন্টস করেছে। আমাদের কোন আর্থিক অস্বচ্ছলতা নেই। তবে বাতেনের ভেতর এক শুন্যতার তৈরি হয়েছে। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখ তার সুপ্ত শুন্যতা জেগে উঠে, ও অপ্রকৃতস্থ হয়ে যায়। ফিরে যায় সেই সময়টাতে, মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য পাগলের মত ছুটতে থাকে এদিক ওদিক। আমরা তাকে বাসায় আটকে রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। গতবারও সে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের করিডোর থেকে তাকে খুঁজে আনা হয়েছিল। অস্থির হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার মেয়েটাকে। নীরা মেডামের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।
আমাদের আর কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। আমরা চারটা পথ শিশুকে দত্তক নিয়েছি। ওদেরকে বাতেন অনেক ভালবাসে। কোন শিশুর কষ্ট ও একদম সহ্য করতে পারে না। কেউ কখনো সন্তানের চিকিৎসার জন্য তার কাছে আসলে নিজ উদ্যোগে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। ওর মত মানুষ আমি পৃথিবীতে দেখিনি।
আমি দুর্বল চিত্তের লোক। সস্তা সিনেমায় করুন কাহিনী দেখলেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। এখন পারি কিভাবে? আমার চোখ বেয়ে পানি পরছে, কিন্তু এত গুলো মানুষের সামনে আমি মোটেও লজ্জিত হচ্ছিনা।